দারসুল কোরআন তাওহীদ ও শিরক
সূরা কাহাফ ৩৫-২৯
সরল অর্থ :
৩৫. নিজের প্রতি জুলুমকারী ব্যক্তি যখন তার মনোমুগ্ধকর বাগাবে প্রবেশ করল। তখন সে অহংকার বশত বলতে লাগল আমি মনে করি না যে, এ সম্পদ কোন দিন ধ্বংস হয়ে যাবে। ৩৬. আর আমার এ আশা নাই যে, কিয়ামত অনুষ্ঠিত হবে তা সত্ত্বেও যদি কখনও আমাকে আমার রবের নিকট উপস্থিত করা হয়, তাহলে সেখানেও আমি ইহা অপেক্ষা উত্তম সম্মান লাভ করব। ৩৭. তার প্রতিবেশি তার কথা শুনে বলল, “তুমি কি কুফরি কর সে মহান আল্লাহর সাথে, যিনি তোমাকে মাটি হতে, আর শুক্রকীট হতে সৃষ্টি করেছেন আর তোমাকে পূর্ণাঙ্গ দেহসম্পন্ন মানুষ করে দাঁড় করে দিলেন। ৩৮. তারপর তার সাথী বলল, আমার রব তো সে আল্লাহই, আমি তাঁর সাথে কাউকে শরীক করিনা। ৩৯. আর তুমি যখন
তোমার বাগানে প্রবেশ করছিলে, তখন তোমার মুখ থেকে এ কথা বের হলনা কেন যে, আল্লাহ যা চেয়েছেন তাই হয়েছে। আল্লাহ ব্যতিত কারো কোন শক্তি নেই। তুমি দেখছ যদিও তোমার থেকে আমার সন্তান ও সম্পদ কম, তারপরও মহান আল্লাহর শোকর আদায় করছি। (সূরা কাহাফ: ৩৫-৩৯)
নামকরণ:
কাহাফ শব্দটি চয়ন করে এর নামকরণ সূরা কাহাফ করা রয়েছে।
নাযিলের সময়কাল:
এ সূরাটি মক্কী জীবনের তৃতীয় অধ্যায়ে নাযিল হয়েছে। মক্কী জীবনের তৃতীয় অধ্যায় প্রায় ৫ম নববী সনের প্রথম হতে শুরু হয়ে প্রায় ১০ নববী পর্যন্ত চলে।
ব্যাখ্যা:
একজন জালেম ব্যক্তি তার নিজের বাগানে প্রবেশ করে মুগ্ধ হয়ে গেল এবং আল্লাহর নেয়ামতের শুকরিয়া আদায় না করে নিজের কৃতিত্বের প্রতি অহংকারী হয়ে মনে করলো যে, আমার এ বাগান আমি অক্ষুণ্ণ রাখতে পারব কেউ ধ্বংস করতে পারবে না। আমি দুনিয়ার জীবনে যেমনি খুশি তেমনি আখিরাতে আল্লাহর নিকট প্রিয়তম এবং সম্মানিত হব। আল্লাহর নাফরমানি করেও তার নিকট আখিরাতের কল্যাণ প্রত্যাশা অনেক।
অর্থাৎ আমি যদি আমার মাবুদের নিকট ফিরে যাই এ শব্দসমূহ প্রমাণ করে যে, সে আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিল, কিন্তু তা সত্ত্বেও তাকে আল্লাহর সাথে শিরক ও কুফরি করার জন্য অপরাধী সাব্যস্ত করা হল। এর কারণ এই যে, শুধু আল্লাহর অস্তিত্বকে অস্বীকার করলেই কুফরি হয়না; বরং অহংকার, গর্ব, পরকাল অমান্য করাও আল্লাহর সাথে কুফরি করার সমান অপরাধ। যে লোক মনে করে আমি একজন বিরাট বুদ্ধিমান, কৌশলী আমার যা কিছু ধন-সম্পদ ও মান সম্মান তা কারো দান ও দয়ার বস্তু নয়; বরং এ সবই আমার নিজস্ব শক্তির জোরে লাভ করা জিনিস। আরও মনে করল যে, আমার ধন-সম্পদ অক্ষয়-স্থায়ী, উহা আমার নিকট থেকে কেড়ে নেবার কেউ নেই, কারো নিকট আমার হিসাব দিতে হবেনা, সে যদি আল্লাহকে মানেও, তবে মানে তাঁর শুধু অস্তিত্ব। কিন্তু নিজের মালিক, মুনীব, শাসক, আইনদাতা পরিচালক হিসেবে তো সে আল্লাহকে মানে না।
অহংকারমূলক কথা শুনে তার সাথী বললেন, তুমি যে সব কথা বলছ তাতে তুমি আল্লাহর সাথে শিরক করছ। আমার প্রভু মহান আল্লাহ শিরক মুক্ত। কোন শক্তি তার সমকক্ষ নয়, আল্লাহ তার কাজে কাউকে সাহায্যকারী হিসেবে গ্রহণ করেন না। অথচ তুমি বাহাদুরি দেখাচ্ছো এবং আল্লাহর দান ও অনুগ্রহকে নিজের চেষ্টার ফল মনে করছ এ সবগুলোই হচ্ছে মহান আল্লাহর সাথে শিরক।
সকল ক্ষমতার মালিক আল্লাহ, সবকিছুই তার হুকুমে পরিচালিত হচ্ছে। আল্লাহ যা চাইবে সে ভাবেই হতে বাধ্য। কোন শক্তিমানের কোন শক্তির আদৌ প্রয়োজন নেই বা হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। কারো মধ্যে কিছু থাকলে তাও মহান আল্লাহর দেয়া তওফীকের কারণেই হয়ে থাকে। অতএব বান্দার সকল ব্যাপারে একমাত্র মহান আল্লাহর সাহায্যের প্রতি ভরসা করাই মুমিনের সফলতার চূড়ান্ত পথ।
আয়াতে অন্য ব্যক্তি ছিল গরীব; কিন্তু সে ছিল আল্লাহর শোকর গুজার এবং আল্লাহর দিকে আহ্বানকারী। গরীব হয়েও সে আল্লাহর প্রিয় বান্দায় পরিণত হয়।
তাওহীদ :
তাওহীদ অর্থ একত্ববাদ। শিরক বিহীন বিশ্বাস ও আমল। আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ, রব ও সৃষ্টিকর্তা নেই। কেউ তাঁর সমকক্ষ ও শরীক নেই। তাওহীদ হচ্ছে ইসলামী বিশ্বাসের মূলভিত্তি এবং সকল নবীদের আগমনের উদ্দেশ্যই ছিল তাওহীদের প্রচার। তাওহীদের বিপরীত হচ্ছে শিরক।
তাওহীদের প্রকারভেদ: তাওহীদ চার প্রকার। যেমন-
১. আল্লাহর নাম ও সিফাতে তাওহীদ:
আল্লাহর নাম ও গুণাবলীর তাওহীদ, আল্লাহ তা'আলার শ্রেষ্ঠত্ব, মহত্ব ও সৌন্দর্যের যাবতীয় গুণাবলীতে এক একক এবং নিরঙ্কুশভাবে পূর্ণতার অধিকারী কেউ তার অংশীদার হতে পারে না। কুরআন ও হাদীস দ্বারা প্রমাণিত সমস্ত নাম ও গুণাবলী, যা আল্লাহ তা'আলার শানে ব্যবহৃত হয়েছে, সবগুলোর প্রতিই কোন রকম সাদৃশ্য ব্যতিরেকে পূর্ণ বিশ্বাস করা। কুরআনে আল্লাহ বলেছেন-
তার সমতুল্য কিছুই নেই। তিনি সর্ব শ্রোতা ও সর্বদ্রষ্টা। (সূরা শূরা: ১১)
২. রুবুবিয়াতে তাওহীদ (প্রভুত্বের ক্ষেত্রে তাওহীদ)
সৃষ্টিকর্তা, রিযিকদাতা ও সৃষ্টির নিয়ন্ত্রণে, প্রতিপালনে আল্লাহ এক ও অদ্বিতীয়। তাঁর কেউ সমকক্ষ নেই। তিনিই সবকিছুর মালিক ও ব্যবস্থাপনাকারী। আল্লাহ কুরআনে বলেন-
তারা কি আপনা আপনিই সৃষ্টি হয়েছে, না তারা নিজেরাই স্রষ্টা? তারা কি আসমান ও যমীন সৃষ্টি করেছে? বরং তারা বিশ্বাস করেনা। (তুর: ৩৫-৩৬) আল্লাহ আরো বলেন-
তোমরা আল্লাহর পরিবর্তে যাদের পূজা কর, ডাক তারা কখনোই একটি মাছি সৃষ্টি করতে সক্ষম নয়, যদিও তারা সকলে একত্রিত হয়। আর মাছি যদি তাদের নিকট থেকে কোন কিছু ছিনিয়ে নেয়, তবে তারা তার নিকট থেকে তা উদ্ধার করতে পারবে না। প্রার্থনাকারী ও যার কাছে প্রার্থনা করা হয়, উভয়ই দুর্বল। (সূরা হজ্জ: ৭৩)
কুরআনে আল্লাহ বলেছেন-
শুনে রাখ, সৃষ্টি তারই এবং আদেশ দানের ক্ষমতাও তার। আল্লাহ বরকতময়, যিনি বিশ্ব জগতের রব।
(সূরা আ'রাফ: ৫৪)
কুরআনে আরো বলা হয়েছে-
তিনি বললেন, আমাদের রব তিনি, যিনি প্রত্যেক বস্তুকে তার উপযুক্ত আকৃতি দান করেছেন। অতঃপর সঠিক পথ প্রদর্শন করেছেন। (ত্বহা: ৫০)
৩. তাওহীদে উলুহিয়াহ (উপাস্য গ্রহণে তাওহীদ):
আল্লাহকে একমাত্র ইলাহ হিসেবে গ্রহণ করা এবং একমাত্র তাঁরই ইবাদত করা। ইবাদতের ক্ষেত্রে আল্লাহর একত্ব এবং তিনি ব্যতিত অন্যান্য যাদের পূজা করা হয়। তাদের সাথে সম্পর্ক ছেদ করা। ইবাদত হচ্ছে একটি কার্যবোধক নাম, আল্লাহর পছন্দনীয় প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য প্রতিটি কথা এবং কাজই এর অন্তর্ভুক্ত। আল্লাহ কুরআনে বলেছেন-
বল, আমার নামাজ, আমার কুরবানী এবং আমার জীবন-মরণ বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহর জন্যে। তার কোন অংশীদার নেই, এসব বিষয়ে আমাকে আদেশ দেয়া হয়েছে এবং আমি প্রথম আনুগত্যশীল।
(সূরা আনআম: ১৬২-১৬৩)
আল্লাহ আরো বলেন-
লোকেরা আল্লাহকে পরিত্যাগ করে এমন সব উপাস্য গ্রহণ করেছে, যারা কিছুই সৃষ্টি করে না। বরং নিজেরাই সৃষ্টি হয়। তারা নিজেদের জন্য কোন কল্যাণ ও ক্ষতি করার ক্ষমতা রাখে না। তারা জীবন, মরণ ও পুনরুজ্জীবনের মালিক নয়। (সূরা ফোরকান: ৩)
৪. আনুগত্যের ক্ষেত্রে তাওহীদ :
মানুষ একমাত্র আল্লাহর বিধান ও নির্দেশ মেনে চলবে। আল্লাহ যা করতে বলেছেন, তাই করতে হবে এবং আল্লাহ যা করতে নিষেধ করেছেন, তা বর্জন করতে হবে। কুরআনের ভাষায়-
আল্লাহ সব কিছুর স্রষ্টা এবং সব কিছুর দায়িত্ব তাঁরই। (সূরা যুমার: ৬২)
কুরআনে বলেছেন-
সাবধান, সৃষ্টি যার নির্দেশ দানের, আইন রচনার অধিকার একমাত্র তাঁরই। তিনি বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক ও বরকতময়। (সূরা আল আরাফ: ৫৪)
আল্লাহ কুরআনে বলেছেন-
তারা বলে আমাদের কি বিধান, আইন রচনা করার কোন অধিকার নেই? তুমি বলে দাও যে, নির্দেশ করার, আইন রচনা করার সকল অধিকার একমাত্র মহান আল্লাহর। (সূরা আলে ইমরান: ১৫৪)
শিরকের প্রকারভেদ
১. আল্লাহর মূল সত্তার সাথে শিরক: আল্লাহকে কারোর থেকে অথবা কেউ আল্লাহ থেকে হওয়া সাব্যস্ত করা। আল্লাহ বলেন-
ইয়াহুদীরা দাবী করে উজাইর আল্লাহর পুত্র। আর খৃষ্টানেরা বলে মসীহ আল্লাহর পুত্র। (সূরা তাওবা: ৩০)
২. আল্লাহর ইবাদতে শিরক:
ইবাদত একমাত্র আল্লাহর জন্য নির্ধারিত। যেমন রুকু, সেজদা, নামাজ, রোজা, কুরবানীর সাথে অন্য কাউকে শরীক করা যাবেনা। যেমন কুরআনে আল্লাহ বলেছেন-
৩. দুআ (প্রার্থনা ও ডাকার) শিরক:
রুজী অনুসন্ধান, রোগ নিরাময় প্রভৃতির উদ্দেশ্যে আম্বিয়া, আওলিয়া ইত্যাদি গায়রুল্লাহকে ডাকলে বা প্রার্থনা করলে শিরক্ হয়। কুরআনে আল্লাহ বলেন,
তুমি আল্লাহ ব্যতিত এমন কাউকে আহ্বান করো না যে তোমার কোন উপকার করে না এবং অপকারও করে না। যদি তা কর তবে তুমি যালেম (মুশরিক) দের অন্তর্ভুক্ত হবে । (সূরা ইউনুস: ১০৬)
No comments:
Post a Comment